শিরোনাম: বাঙালির ঐতিহ্য: জিভে জল আনা শর্ষে ইলিশ তৈরির পারফেক্ট রেসিপি
ইলিশ! নামটা শুনলেই প্রত্যেক বাঙালির মনের মাঝে একটা ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। আর সেই ইলিশ যদি হয় সর্ষের ঝাঁঝালো স্বাদে মাখা, তাহলে তো আর কথাই নেই! গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে শর্ষে ইলিশের মেলবন্ধন যেন এক স্বর্গীয় অনুভূতি। বর্ষার দুপুরে বা পহেলা বৈশাখের উৎসবে শর্ষে ইলিশ ছাড়া আমাদের চলেই না।
অনেকেই শর্ষে ইলিশ রান্না করতে গিয়ে কিছু ছোট ছোট সমস্যায় পড়েন। যেমন, সরিষা তেতো হয়ে যাওয়া বা ঝোলের ঘনত্ব ঠিক না থাকা। আজকের এই রেসিপিতে আমরা এমন কিছু টিপস ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করব, যা অনুসরণ করলে আপনার শর্ষে ইলিশ হবে একেবারে নিখুঁত, ঠিক যেমনটা আপনি চান।
চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক বাঙালির এই ঐতিহ্যবাহী পদের পারফেক্ট রেসিপি।
উপকরণ:
ইলিশ মাছ: ৬ টুকরা (বড় আকারের, পেটিসমেত)
সরিষার তেল: ½ কাপ বা পরিমাণমতো
কালো সরিষা: ২ টেবিল চামচ
সাদা/হলুদ সরিষা: ১ টেবিল চামচ
পোস্তদানা: ১ টেবিল চামচ (ঐচ্ছিক, তবে দিলে ঝোল ঘন ও মসৃণ হয়)
টক দই: ২ টেবিল চামচ (ভালোভাবে ফেটানো)
কাঁচা মরিচ: ৮-১০টি (৪-৫টি বাটার জন্য, বাকিগুলো রান্নার শেষে)
পেঁয়াজ কুচি: ১টি (মাঝারি আকার, খুব মিহি করে কুচানো)
কালোজিরা: ½ চা চামচ
হলুদ গুঁড়া: ১ চা চামচ
মরিচ গুঁড়া: ½ চা চামচ (ঐচ্ছিক, রঙের জন্য)
লবণ: স্বাদমতো
চিনি: ½ চা চামচ (স্বাদের ভারসাম্য আনার জন্য)
প্রস্তুত প্রণালী:
ধাপ ১: মাছ প্রস্তুত করা
প্রথমে ইলিশ মাছের টুকরোগুলো আলতো করে ধুয়ে নিন। অতিরিক্ত ধোয়াধুয়ি করলে ইলিশের আসল স্বাদ ও গন্ধ চলে যেতে পারে। ধোয়ার পর সামান্য লবণ ও হলুদ গুঁড়া মাখিয়ে ১০-১৫ মিনিটের জন্য রেখে দিন।
ধাপ ২: সরিষা বাটা (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ)
কালো ও সাদা সরিষা, পোস্তদানা, ২-৩টি কাঁচা মরিচ এবং সামান্য লবণ একসাথে একটি ব্লেন্ডারে বা শিলপাটায় নিন। অল্প অল্প পানি দিয়ে একটি মসৃণ পেস্ট তৈরি করুন।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস: সরিষা বাটার সময় লবণ ও কাঁচা মরিচ একসাথে বাটলে সরিষার তেতো ভাব পুরোপুরি চলে যায়। অতিরিক্ত সময় ধরে বাটবেন না, এতেও তেতো হয়ে যেতে পারে। বাটা হয়ে গেলে পেস্টটি একটি ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিতে পারেন, এতে খোসা আলাদা হয়ে যাবে এবং ঝোল খুব মসৃণ হবে।
ধাপ ৩: মূল রান্না
১. একটি কড়াই বা প্যানে সরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে গরম করুন। তেল গরম হলে সুগন্ধ বের হওয়া শুরু হবে।
২. এবার তেলে কালোজিরা ফোড়ন দিন। ৩০ সেকেন্ড পর মিহি করে কুচানো পেঁয়াজ দিয়ে দিন এবং হালকা সোনালী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন।
৩. পেঁয়াজ নরম হয়ে এলে এতে সরিষার পেস্ট, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া এবং স্বাদমতো লবণ দিয়ে দিন। মসলাটাকে মাঝারি আঁচে ২-৩ মিনিট ধরে ভালোভাবে কষান, যতক্ষণ না মসলার ওপর তেল ভেসে উঠছে।
৪. এবার ফেটিয়ে রাখা টক দই দিয়ে দিন এবং দ্রুত মসলার সাথে মিশিয়ে আরও এক মিনিট রান্না করুন।
৫. মসলা কষানো হয়ে গেলে এতে ১ কাপের মতো হালকা গরম পানি মিশিয়ে দিন। ঝোল ফুটে উঠলে লবণ মাখিয়ে রাখা ইলিশ মাছের টুকরোগুলো সাবধানে একে একে দিয়ে দিন।
৬. পাত্রটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে মাঝারি আঁচে ৭-৮ মিনিট রান্না করুন। ইলিশ মাছ রান্না হতে খুব বেশি সময় লাগে না।
৭. ৭-৮ মিনিট পর ঢাকনা খুলে মাছগুলো আলতো করে উল্টে দিন। এবার স্বাদের ভারসাম্য আনার জন্য সামান্য চিনি দিন। চেরা কাঁচা মরিচগুলো ছড়িয়ে দিন এবং সবশেষে ১ টেবিল চামচ কাঁচা সরিষার তেল ওপর থেকে ছড়িয়ে দিন। এই কাঁচা তেল শর্ষে ইলিশে এক অসাধারণ সুগন্ধ যোগ করবে।
৮. আবার ঢাকনা দিয়ে মাত্র ২-৩ মিনিটের জন্য হালকা আঁচে দমে রাখুন। তেল পুরোপুরি ওপরে ভেসে উঠলে চুলা বন্ধ করে দিন।
পরিবেশন:
তৈরি হয়ে গেল আপনার জিভে জল আনা ঝাঁঝালো স্বাদের শর্ষে ইলিশ! গরম ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাতের সাথে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে? পরিবেশনের সময় উপরে সামান্য ঝোল দিয়ে মাছের টুকরোগুলো সাজিয়ে দিন।
কিছু জরুরি টিপস ও ট্রিকস:
সরিষার তেতো ভাব দূর করতে: বাটার সময় লবণ ও কাঁচা মরিচ ব্যবহার করুন। টক দইও তেতো ভাব কাটাতে সাহায্য করে।
ইলিশ মাছ বেশি ভাজবেন না: শর্ষে ইলিশের জন্য মাছ না ভাজাই ভালো। এতে মাছের আসল স্বাদ ও নরম ভাব বজায় থাকে।
সঠিক তেল: এই রান্নার আসল স্বাদ পেতে অবশ্যই খাঁটি সরিষার তেল ব্যবহার করুন।
গরম পানি: ঝোলের জন্য হালকা গরম পানি ব্যবহার করলে ঝোলের রঙ ও ঘনত্ব সুন্দর থাকে।
এই রেসিপি অনুসরণ করে রান্না করলে আপনার শর্ষে ইলিশ হবে স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। আপনার রান্নাঘরের ঘ্রাণেই বাড়ির সবাই বুঝে যাবে আজ বিশেষ কিছু রান্না হচ্ছে! রান্নাটি কেমন হলো, তা আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আপনার আনন্দময় রান্নার মুহূর্ত কামনা করছি!

0 Comments